লেখকরা মানুষকে জীবনের গূঢ় রূপ ও রঙের কথা জানান। জানান জটিলতম রহস্য ও গভীরতম খাদের কথা। জীবনকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেন তারা। কখনো সে জীবন স্বপ্ন-স্পর্শে গতিমান হয়, কখনো বিষণ্নতায় ডুবে যায় পঞ্চমীর চাঁদ। স্বপ্ন অথবা বিষণ্নতা_সাহিত্য রস যেমনই হোক তা পাঠক উপভোগ করেন। লেখকরা অতীতকে ধারণ, ঐতিহ্যকে উপস্থাপন এবং ভবিষ্যৎকে দৃশ্যমান করেন। তাই সমাজ-রাষ্ট্রে লেখক মাত্রই বিশেষ গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ, যিনি লেখার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করেন, মানুষও তাকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু এমন অনেকবার হয়েছে, বিশ্বসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অনেক লেখক নিজেই আত্মঘাতি হয়েছেন। বিষণ্নতায় পরাজিত হয়ে হেঁটেছেন আত্মহত্যার পথে।
সম্ভবত লেখকদের প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ৬৫ খ্রিস্টপূর্বে। এ সময় রোমান দার্শনিক ও নাট্যকার সেনেকা আত্মহত্যা করেন। যদিও তিনি রোমান সম্রাট নীরোর রোষে পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। নীরো সেনেকার ছাত্র ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৫ সালে নীরোকে হত্যার জন্যে যে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়, সেই ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে সেনেকার নামও কোনোভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। যদিও গবেষকরা মনে করেন, নীরো হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে সেনেকা কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না। সে সময়ে সেনেকাকে নিজেকে নিজে হত্যা করার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়। সেনেকা নিজেকে হত্যা করতে প্রথমে পায়ের রগগুলো কাটেন। তাঁর মৃত্যু বিলম্বিত হচ্ছে দেখে নিজে বিষও পান করেন। তাতেও তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়াতে শেষে গরম পানির টাবে ঝাঁপ দেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। সেনেকা তাঁর জীবনে কয়েকটি ট্র্যাজেডি নাটক ও গদ্য লিখেছিলেন। দ্য ম্যাডনেস অব হারকিউলিস, দ্য ট্রোজান উইমেন, দ্য ফিনিশিয়ান উইমেন, আগামেমনন, ঈদিপাস, মিদিয়া তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক। হাজার বছর পেরিয়ে সেনেকা এখনো শিল্পমহলে সগৌরবে টিকে আছেন।
ভার্জিনিয়া উলফ-এর জন্ম ১৮৮২ সালের ১৫ জানুয়ারি, ইংল্যান্ডের কিংসটনে। বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ এ লেখক ১৯২৫ সালে লিখেন 'মিসেস ডাল্লাওয়ে', ১৯২৭ সালে 'টু দ্য লাইটহাউজ', ১৯২৮ সালে 'ওরলান্ডো' মতো প্রভাববিস্তারী গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি 'ডিপোলার ডিজঅর্ডার' নামক মানসিক রোগে ভুগছিলেন। ১৯৪১ সালে তিনি তাঁর শেষ উপন্যাস 'বিটউইন দ্যা অ্যাক্টস' লেখার পর-পরই আত্মঘাতি হন। ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ তিনি তাঁর ওভারকোটের পকেটগুলোকে পাথরভর্তি করেন। তারপর হেঁটে নেমে যান খরস্রোতা ওউজ নদীতে। বিশদিন পর ১৮ এপ্রিল নদীতে তাঁর দেহাবশেষ পাওয়া যায়। সুইসাইড নোটে তিনি তাঁর বিষণ্নতাকে দায়ী করেছেন। স্বামীকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছেন : তুমি আমাকে যতটুকু সম্ভব সুখী করেছ। তুমি সে সবই করেছ যা যা কোনও মানুষের তরফে করা সম্ভব। আমার মনে হয় না দুইজন মানুষ মিলে তোমার-আমার চেয়ে বেশি সুখী হতে পারতো, যতদিন না আমার এই ভয়ঙ্কর রোগটা দেখা দেয়। আমি আর এর সাথে যুদ্ধ করতে পারছি না। আমি জানি আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে ফেলছি, আমি না থাকলেই তুমি কাজ করতে পারবে।'
ভার্জিনিয়া উলফের একদশক পরে ১৮৯৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন রাশিয়ান কবি ও নাট্যকার ভস্নাদিমির মায়াকোভস্কি। তিনি কেবল ভালো লিখতেন তা-ই নয়, তাঁর আবৃত্তিও অসংখ্য মানুষকে তন্ময় করে রাখতো। তিনি কিশোরকাল থেকে অধিকারসচেতন ও শ্রেণিসংগ্রামের বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তাঁকে রুশ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ বিবেচনা করা হয়। ব্যক্তিজীবনের মতোই সাহিত্য চর্চায় তিনি শ্রেণিসংগ্রামের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, মায়াকোভস্কিও শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন। সেদিন ছিলো ১৯৩০ সালের ১৪ এপ্রিল। সম্পর্কের টানাপোড়েনে মানসিক বিপর্যস্ত মায়াকোভস্কি এদিন সকাল দশটায় রিভলবার মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন। অনেকে বলেছেন, মায়াকোভস্কি নিজের শিল্পভাবনার শক্তি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। সুইসাইড নোটে তিনি তাঁর আত্মহত্যার ব্যাপারে কাউকে দায়ী না করতে এবং গুজব না ছড়াতে অনুরোধ করেছেন। মায়াকোভস্কির মৃত্যুতে রাশিয়ার সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ১৫ লাখ লোক অংশগ্রহণ করেন।
১৮৭৮ সালে জন্ম নেয়া উরুগুয়ের প্রখ্যাত ছোটগল্পকার হোরাসিও কিরাগোর জীবন ছিলো বিদঘুটে এবং ঘটনাবহুল। তাঁর বাবা দুর্ঘটনায় পড়ে মারা যান, কিরাগোর সৎ বাবাও আত্মহত্যা করেছিলেন। কিরাগোর হাতেই দুর্ঘটনাক্রমে তাঁর এক বন্ধু মারা যান। এজন্যে তাঁর বিচারও হয়। ১৯০৯ সালে তিনি আনা নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। তাঁদের ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। পরে সেই দু সন্তান, এমনকি তাঁর স্ত্রীও সায়ানাইড পানে আত্মহত্যা করেন। ১৯২৭ সালে তিনি তাঁর থেকে ৩০ বছরের ছোট এক নারীকে বিয়ে করলেও সে বিয়ে টিকেনি। হোরাসিও কিরাগো জীবনের পদে পদে মানসিকভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে মাদককে সঙ্গী করে নেন। জীবনের দুঃখ ঘোচাতে ১৯৩৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আর্জেন্টিনার বুয়েনেস আইরেসের একটি হাসপাতালে তিনি সায়ানাইড পান করে আত্মহত্যা করেন। মহান এ লেখককে ছোটগল্প রচনার দক্ষতার জন্যে অ্যাডগার এলান পো'র সাথে তুলনা করা হতো। তাঁর পৃথিবীজোড়া সাড়া জাগানো গল্প 'উয়ান দারিয়েন'।
হোরাসিও কিরাগোও বাংলা ভাষাভাষী পাঠক তেমন না চিনলেও সিলভিয়া প্লাথকে বাঙালি পাঠক মাত্রই বিশেষভাবে চেনেন। প্রথমত তিনি বরেণ্য ইংরেজ কবি, দ্বিতীয়ত তিনি আরেক বরেণ্য কবি টেড হিউজকে বিয়ে করেন। মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি প্রথম আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তখন ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। ১৯৬৩ সালে তিনি টেড হিউজের সাথে বিবাহ-বিচ্ছেদ করে দু সন্তান ফ্রিডা ও নিকোলাসকে নিয়ে আলাদা বসবাস শুরু করেন। কিন্তু বিষণ্নতা তাঁকে পেয়ে বসেছিলো। তিনি আবারও আত্মঘাতি হবার সিদ্ধান্ত নেন। সিলভিয়া প্লাথের আত্মহত্যার পদ্ধতিটাও ভয়ংকর ছিলো। তিনি গ্যাসের চুলোয় মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করেন। দিনটি ছিলো ১১ ফেব্রুয়ারি। কনফেশনাল কবি সিলভিয়া প্লাথ তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে কবিতাগ্রন্থসহ বেশকিছু প্রবন্ধ, উপন্যাস ও শিশুতোষ বই লিখেছেন। কবিতার জন্যে এ কবি ১৯৮২ সালে মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন।
নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে পৃথিবীজুড়ে সর্বাধিক পঠিত লেখকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর 'দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি' বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা উপন্যাস। এ উপন্যাসে লেখক জীবনযুদ্ধ ও হার-না-মানার প্রত্যয়কে চমৎকারভাবে তুলে ধরলেও ব্যক্তি জীবনে তিনি সে প্রত্যয় রক্ষা করতে পারেননি। যিনি বলেছিলেন, মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু পরাজিত হয় না। সেই হেমিংওয়ে যখন আত্মহত্যা করেন তখন পৃথিবীবাসীর বিস্ময়ে সীমাহীন হওয়ারই কথা। হেমিংওয়ে জীবনের শেষ দিনগুলোতে এসে জীবন ও চর্চায় খেই হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল_এই দশ বছর তিনি কোনো সাহিত্য রচনা করেননি। দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে শারীরিক ও মানসিক পীড়নে হেমিংওয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। একবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েও তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। আত্মহত্যার প্রবণতা তাঁর পারিবারিকভাবে ছিলো। তাঁর বাবা ডাঃ ক্লোরেন্স হেমিংওয়ে, ভাই লেইচেস্টার ও বোন উরসুলাও আত্মহত্যা করেছিলেন। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৯৬১ সালের ২ জুলাই ভোরে নিজের শর্টগান মুখে ঢুকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা করার আগে তিনিও সুইসাইড নোট লিখে রেখে গিয়েছিলেন।
জাপানের প্রথম নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ছিলেন ইউসুনারি কাউবাতা (১৮৯৯-১৯৭২)। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : সস্নো কান্ট্রি, থাউজেন্ট ক্রেনেস ও দ্য ওল্ড ক্যাপিটাল। কাউবাতা ১৯৭২ সালে ৭৩ বছর বয়সে গ্যাস টেনে নিয়ে নিজেকে হত্যা করেন। যদিও তাঁর আত্মহত্যার কারণ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এখনো রয়েছে। এনি সেক্সটন আরেক নোবেলজয়ী লেখক যিনি কাউবাতার মতোই গ্যাস টেনে ১৯৭৪ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন। জানা যায়, অ্যানি সেক্সটন আত্মহত্যার আগে ভোদকা খেয়েছিলেন। তারপর গ্যারেজে গিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন চালিয়ে রাখেন। ইঞ্জিনের কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস টেনে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনি তাঁর লেখা শেষ গ্রন্থ The Awful Rowing Toward God-এর পান্ডুলিপি এক রিপোর্টারকে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন এটি প্রকাশ করা হয়। অ্যানি সেক্সটন দীর্ঘদিন ধরে ডিপ্রেশন, পারিবারিক অস্থিরতায় ভুগছিলেন। এ বরেণ্য লেখক ১৯৬৭ সালে Live or die গ্রন্থের জন্যে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সিলভিয়া প্লাথ, হোরাসিও কিরাগো ছাড়াও আরো অনেক বরেণ্য সাহিত্যিক আত্মহত্যার অগ্রহণযোগ্য পথকে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে হার্ট ক্রেন, ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস, জুকিয়ো মিশিমা, হান্টার এস থমসন, জন ব্যারিম্যান, হ্যারি মার্টিনসন, মেরিনা তসভেতেইভা, স্টিফেন জোয়েগ উল্লেখযোগ্য। এঁদের অনেকেই বিষণ্ন ছিলেন। অনেকেই পারিবারিক ও শারীরিকভাবে অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। যেহেতু লেখককে মানুষ ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে_তাই তাঁদের অকালে চলে যাওয়ায় তারা ব্যথিত ও বিমর্ষ হবে এটাই স্বাভাবিক। এমন ব্যথা নিয়েই সেই রোমান ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান উত্তরাধুনিক পাঠকরা পথ হাঁটছেন।
ফজর | ৪:৫৮ |
যোহর | ১১:৪৫ |
আসর | ৩:৩৬ |
মাগরিব | ৫:১৫ |
এশা | ৬:৩১ |
হেরার আলো
|
বাণী চিরন্তন
|
আল-হাদিস
|
২-সূরা বাকারা ২৮৬ আয়াত, ৪০ রুকু, মাদানী পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। ৬৬। আমি ইহা তাহাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীগণের শিক্ষা গ্রহণের জন্য দৃষ্টান্ত ও মুত্তাকীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ করিয়াছি।
সৌভাগ্য হচ্ছে অজস্র সুষ্ঠু কর্ম সুষমার ফল। _ইমারসন।
যে ব্যক্তি উদর পূর্তি করিয়া আহার করে, বেহেশতের দিকে তাহার জন্য পথ উন্মুক্ত হয় না।
|
করোনা পরিস্থিতি | ||
বাংলাদেশ | বিশ্ব | |
আক্রান্ত | ৭,৫১,৬৫৯ | ১৬,৮০,১৩,৪১৫ |
সুস্থ | ৭,৩২,৮১০ | ১৪,৯৩,৫৬,৭৪৮ |
মৃত্যু | ১২,৪৪১ | ৩৪,৮৮,২৩৭ |
দেশ | ২০০ ২১৩ | |
সূত্র: আইইডিসিআর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। |
হ্যাঁ | না | মতামত নেই |