নগর আমাকে নিবে না, প্রকৃতি আমাকে নিবে। খুব জরুরি কাজ না হলে আমি ঢাকাতে যাই না। যতবারই গিয়েছি কাজ অসম্পূর্ণ রেখে চলে আসতে হয়েছে। অসহ্য লাগে নগর। হয়তো নগরকে মনের মতো করে সাজানো হয়নি বলে আমি থাকতে চাইলেও মন সবসময় অস্থির থাকে গ্রামে আসার জন্য। যদিও সব শহর দেখার অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেনি। তারপরও বলবো আমি প্রকৃতিরই। প্রকৃতি আমাকে যতটা আপন করে নিতে পারে নগর ততটা পারে না। প্রকৃতির মাঝেই আমি পরম আনন্দ খুঁজে পাই। খুঁজে পাই নিজেকে। বাংলাদেশের যত জায়গায় গিয়েছি ফিরার সময় তৃপ্তি নিয়েই ফিরেছি। মানে, আসতে তেমন একটা খারাপ লাগেনি। শুধুমাত্র বান্দরবান থেকে অতৃপ্ত মন নিয়ে ফিরে আসতে হলো। খুবই খারাপ লেগেছে আসতে। কেন জানি মনে হচ্ছিলো এটাই আমার আসল বাড়ি। বান্দরবানের সৌন্দর্য আমাকে এতোটাই আকৃষ্ট করেছে যে, আমি তাকে প্রকৃতির সৌন্দর্যের রাজধানী বলে ঘোষণা দিলাম। আর অতৃপ্ত বলেই ঠিক এক মাস পরেই আবার ফিরে আসলাম পৃথিবীর স্বর্গ বান্দরবানে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অর্থাৎ রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি ঘোরার অনেকদিনের শখ ছিলো। কিন্তু যথার্থ সঙ্গী এবং সময় বের করা যায়নি বলে যাওয়া হয়নি। এ সুযোগে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানিয়ে নেই বন্ধুবর ডাঃ ইমাম হোসেন সৌরবকে। সত্যি বলতে কি, তিনি না গেলে যাওয়া হতো না। তার কল্যাণে আমার অন্যতম স্বপ্ন পূরণ হলো। প্রায় এক মাস পরেই অফিসের (আইফার) কর্মকর্তাদের নিয়ে আবার ঘুরে আসলাম বান্দরবান।
কল্পনায় আমি বান্দরবানকে যেভাবে এঁকেছি, বাস্তবে এসে দেখি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সুন্দর। একমাস আগে বান্দরবান যাওয়ার পরিকল্পনা করি। আমাদের নির্ধারিত তারিখ ছিলো ২৪ ডিসেম্বর। বিশেষ কারণে তা পিছিয়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়। বান্দরবান যাবো এই উত্তেজনায় আগেরদিন রাত এক ফোঁটা ঘুমও হয়নি। রাত সাড়ে তিনটায় উঠে গোসল করলাম। প্রচ- শীতে যেখানে সকালেই গোসল করতে চাইতাম না, সেখানে রাতের শেষ ভাগে গোসল করলাম কিন্তু শীত লাগছে না! বুঝতে পারলাম উত্তেজনা কাকে বলে। এতো রাতে ওঠার কারণ হলো আমরা চাঁদপুর থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যাবো। সেখান থেকে বান্দরবান। টিকেট ৫দিন আগেই কাটা হয়েছে। ট্রেন ছাড়বে ভোর ৫টায়। আমরা ৫টার আগেই মেঘনা এঙ্প্রেসে উঠে বসলাম। ৫টার ট্রেন ছাড়লো ২৫ মিনিট লেট করে। ট্রেনের পরিবেশ যতটা চিন্তা করেছি ততটা ভালো নয়। তারপরও প্রথম ট্রেন জার্নি। ভালোই লাগলো। অন্তত বাস জার্নি থেকে আরামদায়ক। আমাদের সফরসঙ্গী আরো দু'জন রয়েছে, একজন জাকির অপরজন সৌরভ। প্রায় সাড়ে ৪ ঘন্টায় আমরা চট্টগ্রামে। রাতে না ঘুমানোর কারণে বেশির ভাগ পথই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসেছি। রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিএনজি অটোরিকশাযোগে বদ্দারহাট বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। সেখানে আমরা নাস্তা সেরে পূর্বাণী গাড়িতে উঠলাম। এ স্ট্যান্ড থেকে শুধুমাত্র পূবালী এবং পূর্বাণী বাসগুলো ছেড়ে যায়। সকাল সাড়ে ১১টায় পূর্বাণী বাসটি বান্দারবানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বান্দারবান উপজেলায় প্রবেশের আগেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাসে বসে বসেই উপভোগ করতে লাগলাম। মাত্র দুই ঘন্টায় আমরা বান্দরবান বাসস্ট্যান্ডে পেঁৗছলাম। স্ট্যান্ডের পাশেই হোটেল হিল ভিউ। চমৎকার হোটেল। দেখেই পছন্দ হয়ে গেলো। কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আমরা এখানেই উঠে গেলাম। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ১০ মিনিটের জন্য বিছানায় দেহখানিকে সঁপে দিলাম। একটু ক্লন্তি দূর করার চেষ্টা। তারপর হোটেলে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।
বান্দরবান জেলার নামকরণ নিয়ে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের প্রচলিত রূপ কথায় আছে, এক সময় এখানে বাস করত অসংখ্য বানর। আর এই বানরগুলো শহরের প্রবেশ মুখে ছড়ার পাড়ে প্রতিনিয়ত লবণ খেতে আসত। এক সময় অনবরত বৃষ্টির কারণে ছড়ার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বানরের দল ছড়া পার হয়ে পাহাড়ে যেতে না পারায় একে অপরকে ধরে ধরে সারিবদ্ধভাবে ছড়া পার হয়। বানরের ছড়া পারাপারের এই দৃশ্য দেখতে পায় এই জনপদের মানুষ। এই সময় থেকে জায়গাটি পরিচিতি লাভ করে 'ম্যাঅকছি ছড়া' হিসাবে। অর্থাৎ মার্মা ভাষায় ম্যাঅক অর্থ বানর আর ছি অর্থ বাঁধ। কালের প্রবাহে বাংলা ভাষাভাষির সাধারণ উচ্চারণে এই এলাকার নাম রূপ লাভ করে বান্দরবান হিসাবে। তবে মার্মা ভাষায় বান্দরবানের নাম 'রদ ক্যওচি ম্রো'। ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জেলা ঘোষণা করা হয়। ক্যাপ্টেন মাগ্রেথ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার প্রথম সুপারিন্টেন্ডেন্ট। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়-চাকমা সার্কেল, মং সার্কেল এবং বোমাং সার্কেল। প্রত্যেক সার্কেলের জন্য একজন সার্কেল চীফ নিযুক্ত ছিলেন। বান্দরবান তৎকালীন সময়ে বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে এই জেলার আদি নাম বোমাং থং। বান্দরবান জেলা ১৯৫১ সালে মহকুমা হিসেবে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে। এটি রাঙ্গামাটি জেলার প্রশাসনিক ইউনিট ছিলো। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ১৮ এপ্রিল, তৎকালীন লামা মহকুমার ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক সীমানাসহ সাতটি উপজেলার সমন্বয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এ জেলার উত্তরে রাঙ্গামাটি জেলা, দক্ষিণে আরাকান (মায়ানমার), পূর্বে ভারত এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও কঙ্বাজার জেলা অবস্থিত। এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৩০৩১ মিঃ মিঃ। সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং বাঁকখালী এ জেলার প্রধান নদী।
খুব চটপটে ছেলে হাসান। সিএনজি অটোরিকশা চালায়। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি এলাকায় গাড়ি চালায়। সবকিছু তার নখদর্পণে। তাকেই আমাদের চলার সঙ্গী করে নিলাম। আমাদের চারজনেরই প্রথম বান্দরবান সফর। বিকাল বেলা। সময় খুব কম। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম হোটেলের আশ-পাশের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে নেই। তাই প্রথমে গেলাম রামজাদি মন্দির। কয়েক শ' ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বাঁধানো চত্বর পার হলেই বৌদ্ধ স্থাপত্যে গড়া সাদা-সোনালি কারুকার্যের অপূর্ব মন্দির। মন্দিরের সোনালি চূড়ায় ঠিকরে পড়ছে সূর্যের আলো। অনিন্দ্যসুন্দর এই মন্দিরের নাম রামজাদি। পর্যটন নগর বান্দরবানের মুকুটে নতুন পালক। মন্দিরের উচ্চতা ১৩০ ফুট। সেদিক থেকে এটি দেশের অন্যতম উঁচু মন্দিরও। বান্দরবানের আরেক বিখ্যাত মন্দির স্বর্ণজাদির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি এর উচ্চতা। ১২ বছর ধরে নির্মাণকাজ চলার পর ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে এটি পর্যটক ও পুণ্যার্থীদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই রামজাদির সৌন্দর্য দেখতে ছুটছেন পর্যটকেরা।
বান্দরবান রোয়াংছড়ি সড়কের হদাবাবুর ঘোনায় পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হয়েছে রামজাদি। মূল শহর থেকে ইজিবাইক কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মন্দিরে পেঁৗছাতে সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট। মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বারেই স্থাপন করা হয়েছে নয়টি বুদ্ধমূর্তি। এ ছাড়া মূল মন্দিরের ভেতরে ছোট-বড় আরও ১ হাজার ৬১টি বুদ্ধ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। পাহাড় ও অরণ্যবেষ্টিত এই মন্দিরের স্থপতি মিয়ানমারের উসান উইন। গুরু ভান্তে হিসেবে খ্যাত স্বর্ণমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা উ পঞা জোত মহাথের এই মন্দিরেরও প্রতিষ্ঠাতা। মূল জাদি (মন্দির) ছাড়াও এখানে আরও ২৭টি ছোট জাদি রয়েছে। এগুলোর প্রতিটির উচ্চতা ২১ ফুট। মূল জাদি ও সহজাদিগুলোতে পুণ্যার্থীদের দান করা ১ হাজার ৬১টি বুদ্ধমূর্তি বসানো হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি দ-ায়মান শ্বেতপাথরের বুদ্ধমূর্তি।
লম্বা সৌরবের তাগাদায় এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। পুরো সফরে তিনি আমাদেরকে এঙ্টা বিনোদন দিয়েছেন। তার বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক হলো তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকেন। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো পর্যটন এলাকায় আমাদেরকে বেশিক্ষণ থাকতে না দেওয়া। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এটা যেন তার উপর অর্পিত দায়িত্ব।
তারপর গেলাম বুদ্ধ ধাতু জাদি, যা বান্দরবন স্বর্ণ মন্দির নামে সুপরিচিত। মন্দিরটি বান্দরবান শহরের বালাঘাট এলাকায় অবস্থিত। এটি বালাঘাট থেকে ৪ কিলোমিটার এবং বান্দরবান শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ধাতু বলতে কোন পবিত্র ব্যক্তির ব্যবহৃত বস্তুকে বোঝায়। এই বৌদ্ধ মন্দিরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা বড় হীনযান বৌদ্ধ মন্দির। ২০০০ সালে বার্মার স্থাপত্যবিদের তত্ত্বাবধানে মন্দিরটি নির্মিত হয়। মন্দিরটির নির্মাণ শৈলী মায়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ মন্দিরগুলোর আদলে তৈরি করা হয়। এই পাহাড়ে একটি পুকুর আছে, নাম দেবতা পুকুর। দেবতা পুকুরটি সাড়ে ৩শ' ফুট উঁচুতে হলেও সব মৌসুমেই পানি থাকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বুদ্ধ ধাতু জাদি ক্যাং। এই জাদিটি এখন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থানই নয় দেশী বিদেশী পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয় স্পটে পরিণত হয়েছে। এটি স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত পেলেও এটি স্বর্ণ নির্মিত নয়। মূলত সোনালি রঙের জন্যেই এটির নাম হয়েছে স্বর্ণমন্দির। ভেন. ইউ পান্নইয়া জোতা মাহাথেরো ২১ শতকে এটি নির্মাণ করেন। মন্দিরটি স্থানীয়দের কাছে কিয়াং নামে পরিচিত। এর অপর নাম মহাসুখ প্রার্থনা পূরক বুদ্ধধাতু চেতী। গৌতমবুদ্ধের সম-সাময়িক কালে নির্মিত বিশ্বের সেরা কয়েকটি বুদ্ধ মূর্তির মধ্যে একটি এখানে রয়েছে। এই প্যাগোডাটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সেরাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই প্যাগোডা থেকে বান্দরবানের বালাঘাটা উপশহর ও এর আশপাশের সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া বান্দরবান রেডিও স্টেশন, বান্দরবান চন্দ্রঘোনা যাওয়ার অাঁকাবাঁকা পথও দেখা যায়। প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে এখানে মেলা বসে। এখান থেকে দ্রুতই বের হয়ে রওয়ানা দিলাম নীলাচলের দিকে।
'হাওয়া বদল' অতিপ্রাচীন রোগ নিরাময়ের টনিক। মানে জায়গা বদল করে কিছুদিনের জন্য পছন্দের কোনো গন্তব্য থেকে বেড়িয়ে আসা। আর এতেই অসুস্থ শরীরের উন্নতি দেখতেন চিকিৎসকগণ। হালের প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসা এই 'হাওয়া বদল' চিকিৎসা কমে গেছে। মানুষ এখন নিজেই বোঝে কোথায় গেলে সে শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠবে। বান্দরবানের নীলাচল তেমনি এক স্বর্গীয় অনুভূতি ছড়ানো পর্যটন গন্তব্য। যেখান থেকে সকালের সূর্যোদয় ও বিকেলের রোমাঞ্চকর সূর্যাস্ত দেখা যায়। নীল আকাশ যেখানে পাহাড়ে এসে ঘুমায়। আর আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে কঙ্বাজার সমুদ্র সৈকতের অপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়বে দর্শনার্থীদের। কথিত আছে নীলাচলের বিশুদ্ধ শীতল বাতাস যেকোনো পুরানো রোগ নিরাময়ের টনিক হিসেবে কাজ করে। এক কথায় বলা যায় মানসিক প্রশান্তির আরেক নাম নীলাচল। নয়নাভিরাম বান্দরবানের নীলাচল। ২ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এ পাহাড়টি। যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই সবুজ ও নীল আকাশের হাতছানি। চারপাশে সবুজ পাহাড়ের কোলঘেঁষে অাঁকা-বাঁকা রাস্তা চলে গেছে দূর-দূরান্তে। তাছাড়া নীলাচলের সৌন্দর্যে ভিন্নতা এনে দেয় বর্ষা মৌসুম। এই পাহাড় থেকে পাখির চোখে দেখা যায় বান্দরবান শহর। এসময় কখনো রোদ্দুর কখনো বৃষ্টির পরশ ভ্রমণপিয়াসুদের মনে আনে স্বর্গীয় অনুভূতি। সেখানে নির্মিত হয়েছে 'ঝুলন্ত নীলা' 'নীহারিকা' ও 'ভ্যালেন্টাইন' পয়েন্ট নামে বেশ কিছু স্পট। যেখান থেকে নীলাচলের ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। জোছনা রাতে নীলাচলের সৌন্দর্য দেখা না হলে নীলাচলের সৌন্দর্য অবলোকনে অপূর্ণতা রয়েই যাবে। দিনভর পাখ-পাখালির কিচির মিচির শব্দে মুখরিত এ জায়গাটির আশপাশের পাহাড়ের ঢালুতে দেখতে পাবেন তঞ্চঙ্গ্যা, বম সমপ্রদায়ের বেশ কয়েকটি পাহাড়ি গ্রাম। পাহাড়ি গ্রাম ও আদিবাসীদের জীবনযাত্রা দেখতে চাইলে হেঁটে যেতে হবে পাহাড়ের পাদদেশে। তবে সাবধান, বর্ষায় পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা বেশ বিপদজনক আর জঙ্গলে বিষাক্ত সাপের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়।
নীলাচলে নীলাম্বরী নামে একটি আকর্ষণীয় রিসোর্ট রয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সাধারণ দর্শনার্থীদের থাকার সুযোগ থাকলেও রিসোর্টের অতিথিরা সর্বক্ষণ থাকার সুযোগ পান সেখানে। প্রতিটি কটেজে দুটি করে রুম আছে। নীলাচলে বর্ষা, শরৎ এবং হেমন্ত এ তিন ঋতুতে ছোঁয়া যায় মেঘ। এখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় দূরে অবস্থিত শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদী। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ায় নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র অবস্থিত। মূল সড়ক থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার এঁকেবেঁকে রাস্তায় পাহাড় বেয়ে পেঁৗছতে হয় নীলাচলে। মাঝে পথের দুই পাশে ছোট একটি পাড়ায় দেখা যাবে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। নীলাচলে ঝুলন্ত নীলা থেকে শুরু করে ক্রমশ নিচের দিকে আরও ক'টি বিশ্রামাগার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নীহারিকা এবং ভ্যালেন্টাইন পয়েন্ট। পাহাড়ের ঢালে ঢালে সাজানো হয়েছে এ জায়গাগুলো। একটি থেকে আরেকটি একেবারেই আলাদা। একেক জায়গা থেকে সামনের পাহাড়ের দৃশ্যও একেক রকম। তবে মূল নীলাচলের সৌন্দর্য অনেক বেশি। এখান থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় আরও ভালোভাবে। নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের একেবারে চূড়ায় পর্যটকদের জন্য আছে বেশ ক'টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। নীলাচলের মূল পাহাড়ের শিখরের চারপাশেই মনোরম স্থাপত্য শৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছে এসব কেন্দ্র। একটি থেকে আরেকটি একেবারেই আলাদা। বর্ষা এবং বর্ষা পরবর্তী সময়ে এখানে চলে মেঘের খেলা। কিছুক্ষণ পর পরই দূর পাহাড় থেকে মেঘের ভেলা ভেসে আসে নীলাচলের চূড়ায়। চারপাশ ঢেকে ফেলে শীতল নরম পরশে। অসম্ভব সুন্দর এই নীলাচল। নীলাচলকে নিয়ে বহু কবিতা রচিত হয়েছে। নীলাচল নিজেই একটি কবিতা।
'মেঘ বালিকা পাহাড়ের বুঝি/ললাট দিয়েছে চুমে/দুহাতে মধুর স্বপ্ন বুনিছে/জোছনায় নিশি ঘুমে।/গিরিখাদ যেন মৃত্যুর সম/পাহাড়ের হৃদিধামে/নির্ঝরিণী সুধা ঢালে/পাহাড়ের বুকে নামে।/মোর মনেরই চুপ কথাগুলো/রূপকথা বুঝি অাঁকে/মোহিনী রূপের হাতছানি দিয়ে/পাহাড় কন্যা ডাকে।/আবেগের আজ বেড়ে গেছে বেগ/নয়নে জেগেছে মোহ/যতদূর চাহি তোমারেই দেখি/সবুজের সমারোহ। (কবি-ডাঃ তানিয়া রহমান)
নীলাচলের সৌন্দর্যের মাদকতায় আমি বুঁদ হয়ে গেলাম। কিছুতেই সেখানে থেকে ফিরে আসতে মন চাইছে না। কিন্তু লম্বা সৌরবের পীড়াপীড়িতে সে সময় বের হলেও ঠিক একমাস পর আবার যখন ফিরে আসলাম, শুধুমাত্র এখানেই কাটিয়েছি দীর্ঘ সময়। ইচ্ছে মতো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রকৃতির প্রেমে হাবুডুবু খেলাম। এক অন্ধ শিল্পীর কণ্ঠে গান শুনলাম। উপজাতি তরুণী ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় করলাম। নৃ গোষ্ঠী পাহাড়ী নারীদের হাতে বানানো বিনি্ন ধানের গুড়োর পিঠা খেলাম।
প্রথমবার যখন এখানে এলাম, তখন তাড়াহুড়া করে চলে যাওয়ার কারণ মেঘলা পর্যটন কমপ্লেঙ্। নীলাচলেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তারপরও দ্রুত সময়ের মধ্যেই হাসান আমাদেরকে সেখানে নিয়ে গেলো। কিন্তু সন্ধ্যার পর সেখানে তেমন কিছু দেখতেও পেলাম না, উপভোগও করতে পারলাম না। ২য় বার তা ষোলকলা পূর্ণ করলাম। টিলার গা বেয়ে এঁকেবেঁকে তেল চিকচিকে একটি সড়ক পেঁৗছে গেছে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেঙ্।ে শহর থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার। বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামগামী সড়কের পাশে পড়বে মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র।
মেঘলার প্রধান ফটক থেকেই চোখে পড়ে বিশাল লেক। সেই লেকের স্বচ্ছ পানিতে রয়েছে নানান ডিজাইনের নৌকা। যেখানে খুবই স্বল্প খরচে মনের আয়েশে পানিতে ভেসে বেড়ানো যায়। তবে ইঞ্জিনের বিকট শব্দ নৌ ভ্রমণের আনন্দ বিষাদে পরিণত করে। নৌ ভ্রমণের যে অনুভূতি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তা পাওয়া যায় না। কিন্তু মেঘলায় পানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই আপনার কানে আসবে না। বর্ণিল সব নৌকা চলে ব্যাটারীতে। এ কারণে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আপনাকে নীরবতার অনুভূতি যোগাবে। বিশাল আকৃতির লেকের পরে তিনশ' ফুট উঁচু পাহাড়। দূষণমুক্ত এই লেকে চলার সময় দেখতে পাবেন নানান জাতের জলজ পাখির খেলা। মাথার উপর গাছের ডাল পানি ছুঁই ছুঁই করছে। সে সব গাছে কাঠ বিড়ালীর তিড়িং বিড়িং খেলা ও বিভিন্ন পাখির কলতান সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
যখন নৌকায় ঘুরছেন তখন মাথার উপর সাঁই সাঁই করে চলছে ক্যাবল কার। যাতায়াত মিলিয়ে ১৬০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এ ক্যাবল কার এক পাহাড় থেকে লেকের উপর দিয়ে অন্য পাহাড় ছুঁয়ে আসা মনে রোমাঞ্চকর অনুভূতির সঞ্চার করে। পানির দুশ' ফুট উপরে দিয়ে ক্যাবল কারে যাতায়াতের সময় শূন্যে ভেসে থাকার দারুণ এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। কারো কারো মনে কিঞ্চিত ভীতিও সঞ্চার করতে পারে। আয়তনের দিক থেকে খুব বেশি বড় নয়, তবে বেশ পরিপাটি। বেশ কয়েকটি ছোট বড় পাহাড় বেষ্টিত এই পর্যটন কেন্দ্রে নানামুখী বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রধান ফটক থেকে কংক্রিটের ঢালু ওয়াকওয়ে দিয়ে নেমে গেলেই সামনে পড়বে পিকনিক স্পট। সেখানে রয়েছে উন্মুক্ত মঞ্চ। পিকনিক স্পটের পাশেই রয়েছে শিশু পার্ক। যেখানে শিশুদের মাতিয়ে রাখার জন্য রয়েছে নানাবিধ বন্দোবস্ত। শিশু পার্ক সংলগ্ন লেকের উপর ঝুঁকে রয়েছে রেস্ট হাউস। যার বারান্দায় বসে চুটিয়ে উপভোগ করতে পারবেন চাঁদনী অথবা অমাবশ্যার রাত। তখন লেকের স্বচ্ছ জলের শীতল হাওয়া অন্যরকম ভালো লাগার পরশে জুড়িয়ে দিয়ে যাবে মন। যান্ত্রিকতা সেখানে কোনোভাবেই বাদ সাধবে না।
পিকনিক স্পটের দুইদিকে রয়েছে দু'টি ঝুলন্ত বীজ। একটি দিয়ে পার হয়ে ওই পারের টিলায় অবস্থিত মিনি সাফারী পার্ক, চিড়িয়াখানা ঘুরে আরেকটি সেতু দিয়ে পার হয়ে আসা যায়। নান্দনিক এসব ঝুলন্ত ব্রিজ খুবই উপভোগ্য। দোলনার মতো দুলুনি আপনার মনকেও দোলা দিয়ে যাবে। ঠিক মাঝামাঝি পেঁৗছে গেলে মনে হবে এই বুঝি টুপ করে খসে পড়বে পানিতে। কিন্তু না, কিছুটা ভয় ধরিয়ে দিলেও দুই দিকের শক্ত বাঁধন ঠিকই আগলে রাখবে আপনাকে।
টিলাগুলো বাহারী বৃক্ষে আচ্ছাদিত। জেলা প্রশাসন নতুন করে আরও বৃক্ষ লাগিয়েছে। পর্যটন কেন্দ্রটির আরেকটি উপভোগ্য বিষয় রয়েছে তা হচ্ছে তাজা ফলের দোকান। যেখানে পেঁপে, কলা, জাম্বুরা, পেয়ারা, আনারস, মাল্টা পাবেন একেবারে টাটকা। সামনে বেঞ্চ পাতা, তাতে বসে স্বল্পমূল্যে পাহাড়ী সতেজ ফলে উদরপূর্তি করতে পারেন।
পরদিন ভোর ৬টায় আমরা হোটেল থেকে বের হলাম। উদ্দেশ্য প্রথমে চিম্বুক তারপর নীলগিরি। আমরা যখন চিম্বুকে পেঁৗছলাম তখনো যথাযথ কর্তৃপক্ষ আসেনি। তবে গেটম্যান ছিলো। তাকে অনুরোধ করলে সে আমাদের ভিতরে ঢুকতে দেয়, তবে বের হয়ে এসে আমরা টিকেট কেটেছি। চিম্বুকের সৌন্দর্য দেখে মনে হয়েছে আজকের দিনটি ভালো যাবে। বাংলার দার্জিলিং খ্যাত চিম্বুকের পরিচিতি অনেক পুরানো। পাহাড়ের এই দৃশ্যটি অতি চমৎকার। এ পাহাড় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের দৃশ্য যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করবে। বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ চিম্বুক পাহাড় বান্দরবানের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। বান্দরবান সদর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে এই পাহাড়টি সমুদ্রের ২৬০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। পাহাড়ি অাঁকাবাঁকা রাস্তায় চিম্বুক পাহাড়ে যাওয়ার পথে আপনি রোমাঞ্চিত হবেন। আদিবাসীদের গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের অতি সাধারণ জীবনযাত্রা দেখে আপনি বাধ্য হবেন টিকে থাকার জন্যে আমাদের পূর্বসূরিদের জীবন সংগ্রামকে স্মরণ করতে। গ্রামের এসব আদিবাসী প্রকৃতির মতই সরল ও সাধারণ। চিম্বুকের উপর থেকে নিচে তাকালে মনে হবে আপনি মেঘে ভেসে আছেন। রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় পাহাড়ের উপর মেঘের দেখা পাবেন। এছাড়া পাহাড়ের উপর থেকে দিগন্তজুড়ে অাঁকাবাঁকা পাহাড়কে আপনার কাছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতই মনে হবে।
পাহাড় নাকি সাগর, এই দু'টি প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মধ্যে কোন্টা বেশি প্রিয় তা হয়তো নির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন না পর্যটনপ্রেমীরা। তবে হয়তো অনেক প্রেমিক তার প্রিয়াকে পাহাড় কিনে দেওয়ার রোমান্টিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। আর বাংলাদেশের পাহাড়ী সৌন্দর্যের মধ্যে পাহাড়ের রাণী হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত চিম্বুক পাহাড়। চিম্বুক যাওয়ার রাস্তার দুই পাশের পাহাড়ী দৃশ্য খুবই মনোরম। চিম্বুকে যাওয়ার পথে সাঙ্গু নদী আপনার ভ্রমণকে আরও বেশি আকর্ষণীয় ও নান্দনিক করে তুলবে। পাহাড়ের মাঝে সড়ক দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়ার সময় মনে হবে গাড়িতে করে বুঝি চাঁদের বুকে পাড়ি জমাচ্ছেন। ২৬০০ ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে এ অপরূপ বিচিত্র প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাবেন চিম্বুকে। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন নিচে ভেসে যাচ্ছে মেঘের ভেলা। পার্শ্ববর্তী জেলা কঙ্বাজার আর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাগুলোকে দেখা যায় এখান থেকে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ের পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখে মনে হয় মেঘের স্বর্গরাজ্য ভাসছে।
থানছি সড়কের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় চিম্বুক অবস্থিত হওয়ায় এখানে হোটেল বা রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেনি। জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে একটি রেস্টহাউস আছে। জেলা প্রশাসকের অনুমতিক্রমে রাত্রি যাপনের সুযোগ রয়েছে। চিম্বুকের পাশে সেনাবাহিনীর ক্যান্টিন রয়েছে। এখানেই আমরা সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। এখানে দুপুরের খাবার পাওয়া যায়। বান্দরবান থেকে চিম্বুক যাওয়ার পথে মিলনছড়ি ও শাকুরা নামে ২টি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে।
চিম্বুকের চূড়া থেকে যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে প্রবহমান সাঙ্গু নদী যা আপনাকে নিয়ে যাবে অনেক দূরে। ভাগ্য যদি ভাল হয় আর আবহাওয়া যদি আপনার পক্ষে থাকে তবে চিম্বুকের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারেন মেঘের দলকে। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। এখানে থাকার জন্য সড়ক বিভাগের একটি রেস্ট হাউস রয়েছে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের একটি অত্যাধুনিক রেস্ট হাউজ এখানে নির্মিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এখানেও রাত্রি যাপন করতে পারেন। এই রেস্ট হাউজে রাত্রি যাপনের অনুভূতি একেবারেই আলাদা। এমন নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় চাঁদের সাথে নিশি বন্ধুত্ব আপনাকে নস্টালজিক করে তুলবে। এটি এতটাই অপরূপ যে, সারা জীবন যদি একটি ভ্রমণের কথা সবাইকে বলতে হয় তবে হয়তো আপনি চিম্বুকে রাত্রিযাপনের বণর্নাই দিবেন। একসঙ্গে পাহাড়, নদী, সমুদ্র, ঝর্ণাধারা, বন-বনানীর সৌন্দর্যের দেখা মিলে বাংলার দার্জিলিংখ্যাত চিম্বুক পাহাড়ে উঠলে।
চিম্বুক থেকে আমরা সরাসরি চলে গেলাম নীলগিরিতে। নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র নীলগিরি পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উচ্চে অবস্থানের কারণে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র সর্বদা মেঘম-িত। আর এটাই এই পর্যটন কেন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে নীলগিরি ধীরে ধীরে দেশব্যাপী মানুষের কাছে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। এই পুরো পর্যটন কেন্দ্রটিই প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং তারাই এর পরিচালনা করে থাকেন। এই পর্যটন কেন্দ্রটি বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে কাফ্রুপাড়াসংলগ্ন পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত। বান্দরবানের আলীকদম থেকে থানচীগামী রাস্তা ধরে পাহাড়ী পথে নীলগিরি পেঁৗছানো যায়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটন কেন্দ্রগুলোর একটি নীলগিরি। অনেকেই মেঘের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হাজার হাজার টাকা খরচ করে প্রতিবেশী দেশে যান দার্জিলিং দেখতে। কিন্তু আমাদের এ নীলগিরি রূপ-মাধুর্যে ওপারের দার্জিলিংয়ের চেয়ে কম কিসে? কী নেই আমাদের নীলগিরিতে। প্রকৃতি যেন তার সবটুকু সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে বসে রয়েছে পর্যটকদের মনে আনন্দ দিতে। বিশ্বাস না হলে পরিবার নিয়ে ঘুরেই আসুন না বাংলার দার্জিলিংখ্যাত বান্দরবান থেকে।
পাহাড়ের গোড়া থেকে চূড়া অবধি সবুজের চাদরে মোড়া। খাড়া পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জুম চাষ পদ্ধতিতে জাম্বুরা, পেঁপে, জলপাই, আম, কাঁঠাল, কমলালেবু, কলা, আনারস ও পেয়ারার বন সৃজন করেছেন পাহাড়ি ললনারা। নীলগিরি গেলে পথে চোখে পড়ে পাথুরে ঝর্ণা শৈল প্রপাত। এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি এই হলো নীলগিরি। উচ্চতার কারণে শীত-বর্ষায় বান্দরবান বেড়ানোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা এটি। অবশ্য বান্দরবানে প্রায় সারা বছরই কম-বেশি বৃষ্টি থাকে।
পর্যটকদের সুবিধার্থে পাহাড়ের ঢালে নতুন একটি রেস্টুরেন্ট তৈরি করা হয়েছে। এখানে বসে খেতে খেতে ডানে-বাঁয়ে চোখ বুলালে দূর-বহুদূরে দেখা যায় দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডাং, পাহাড় চূড়ার বগা লেক, কঙ্বাজারের সমুদ্রসৈকত ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। রেস্টুরেন্ট ছাড়াও পার্কিং এলাকা থেকে নীলগিরি চূড়ায় হেঁটে ওঠার জন্য নান্দনিক কারুকার্যে তৈরি করা হচ্ছে ওয়াক ওয়ে। নানা রং ও ঢংয়ে পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে কয়েকটি প্রশস্ত চত্বর। এগুলোর মাঝে বসানো হয়েছে নজরকাড়া নকশায় অনেক বসার বেঞ্চ ও শেড। এগুলোতে বসে প্রিয়জনের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দেয়া যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নীলগিরিতে রাতযাপনের জন্য সেনাবাহিনী পরিচালিত মেঘদূত, আকাশনীলা, নীলাঙ্গনা, হেতকরা রাইচা, মারমা রাইচা নামের আকর্ষণীয় কয়েকটি কটেজ রয়েছে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এসব কটেজে অবস্থান ও রাতযাপনের জন্য সেনাবাহিনীর বান্দরবান ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে আগাম যোগাযোগ করতে হয়।
সাঙ্গু পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি নদী। স্থানীয়ভাবে এটি শঙ্খ নদী নামে পরিচিত। কর্ণফুলীর পর এটি চট্টগ্রাম বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। বাংলাদেশের ভেতরে যে কয়টি নদীর উৎপত্তি সাঙ্গু তার অন্যতম। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বান্দরবানের মদক পাহাড়ে এ নদীর জন্ম। পর্বতশীর্ষ থেকে নেমে এসে বান্দরবান শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সাঙ্গু।
উৎসমুখ হতে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এই নদীর দৈর্ঘ্য ১৭০ কিলোমিটার। এ জেলার যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ নদী অন্যতম মাধ্যম। বান্দরবান শহরের পূর্ব পাশে পাহাড়ি ঢালে বয়ে চলা সাঙ্গু দেখতে অপরূপ। পাহাড়ের কোল বেয়ে এঁকেবেঁকে চলছে কোথাও প্রমত্ত আবার কোথাওবা শান্ত এই নদী। পাহাড়ি ঢালে বয়ে চলা এই নদী দেখতে দারুণ দৃষ্টিনন্দন। সাঙ্গু ছাড়া বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন অপূর্ণ। নদীটি পার্বত্য চট্টগ্রামে উত্তরদিকে বৃত্তাকারে বান্দরবান পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। পূর্বদিক দিয়ে বান্দরবানে প্রবেশ করে নদীটি জেলার পশ্চিম দিক দিয়ে বের হয়েছে। অপূর্ব সুন্দর এই পাহাড়ি নদীই চন্দনাইশে এসে শঙ্খ নামে পরিচিত হয়েছে। এই নদীর দুই তীরের পাহাড়, বন ও ঝর্ণার সৌন্দর্যে আপনি বিমোহিত হবেন। এক কথায় এই নদীটির সৌন্দর্যে আপনি শুধু অবাকই হবেন না বরং মুগ্ধতা আপনাকে গ্রাস করবে। এই সৌন্দর্য সত্যিই ভুবন ভোলানো। শীতকালে এই নদীটিতে তেমন স্রোত না থাকলেও বর্ষাকালে থাকে প্রবল স্রোত। বান্দরবান এতোই সুন্দর যে, আপনি যদি একবার বান্দরবান ভ্রমণ করেন তাহলে বারবার যেতে চাইবেন। নান্দনিক সব স্থানের মধ্যে আরেকটি নাম মিলন ছড়ি। চারিদিকের সবুজ পাহাড় আপনাকে মুগ্ধ করবে। এটি বান্দরবান জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। মিলন ছড়ি থেকে সাঙ্গু নদী স্পষ্ট দেখা যায়।
বান্দরবান শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে থানচিমুখী সড়কে শৈল প্রপাত ঝর্ণাটি অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঝর্ণাগুলোর মধ্যে শৈল প্রপাত অন্যতম, যেটি দেখতে প্রচুর পর্যটক এসে থাকে। বর্ষাকালে এই ঝর্ণায় পানির প্রবাহ তীব্র আকার ধারণ করে। শৈল প্রপাতের পানি স্বচ্ছ এবং ঠা-া। এই ঝর্ণার পানি ব্যবহার করতে পারার কারণে শৈল প্রপাতের কাছে কয়েকটি গ্রাম গড়ে উঠেছে। স্থানীয়রা এই ঝর্ণার পানি পান করা এবং গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করে। স্থানীয় বমদের বিশ্বাস : বগা লেক থেকেই এর উৎপত্তি।
এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সৃষ্টি। ঝর্ণার হিমশীতল পানি এখানে সর্বদা বহমান। এই ঝর্ণার পানিগুলো খুবই স্বচ্ছ এবং হিম শীতল। বর্ষাকালে এ ঝর্ণার দৃশ্য দেখা গেলেও ঝর্ণাতে নামা দুষ্কর। এখানে দুর্গম পাহাড়ের কোল ঘেঁষা আদিবাসী বম সমপ্রদায়ের সংগ্রামী জীবন প্রত্যক্ষ করা যায়।
এখানে বম নারীদের নিজ হাতে তৈরি উলের মাফলার, কম্বল, চাদর ও হাতে তৈরি টুকিটাকি জিনিসপত্র পাওয়া যায়। মূল রাস্তা ও প্রপাতের সিঁড়ির গোড়ার দিকে একটু সমতলে এ রকম প্রায় ২০টি দোকান রয়েছে। প্রায় সব দোকানেই বিক্রেতা বম নারী বা তরুণী। এছাড়াও বম পাহাড়ী বয়স্কা কিছু নারী ও পুরুষকে দেখা গেলো পাহাড়ে নিজেদের উৎপাদিত ফল বিক্রি করতে।
পরদিন ভোরে চান্দের গাড়িতে করে রওয়ানা দেই বগালেক দেখতে। বগালেক বান্দরবানের গহীনে লুকিয়ে থাকা অপার সৌন্দর্যের আধার। যতই বগালেক নিয়ে ভাবি আর দেখি রহস্যের কুল কিনারা পাই না। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২শ' ফুট ওপরে পাহাড়ের মধ্যখানে প্রাকৃতিক এ লেক দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। স্বাদু পানির এ লেককেন্দ্রিক পর্যটন যার হাত ধরে এগিয়েছে তিনি সবার প্রিয় সিয়াম দিদি। স্কুল শিক্ষকতার পাশাপাশি ট্রেকারদের থাকা-খাওয়ার সামান্য ব্যবস্থা করে আস্থা অর্জন করেন তিনি। শুরু করেন নিজের বাড়িতে ২০ টাকায় থাকার ব্যবস্থার মাধ্যমে। পর্যায়ক্রমে সেই থাকার খরচ বেড়ে হয়েছে ১শ' টাকা। এখন শুধু সিয়াম দিদি নন, রয়েছে আরও ১০-১২টি কটেজ। লেকের পাড়েও রয়েছে বেশ কয়েকটি। সব বাঁশের। কাঠেরও আছে কিছু কিছু। এক রুমে ১০-২০টি বেড, বালিশ। বেড হিসেবে ভাড়া নেওয়া হয়। সিয়াম দিদি স্বীকার করলেন, টাকা বেশি নিলে তো সেরকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বেডও দিতে হবে। যেটা তাদের পক্ষে সত্যি কঠিন। কোনো রকম থাকার ব্যবস্থা করতে পেরেই খুশি তিনি।
এখানে থাকার পাশাপাশি রয়েছে খাওয়ার ব্যবস্থাও। খাবারের মেন্যুতে খুব বৈচিত্র্য আনার সুযোগ তাদের নেই। আতপ চালের ভাত, আলু ভর্তা, ডিম, জুমের মিষ্টি কুমড়া, ডালই প্রধান। এছাড়া কালেভদ্রে মেলে পাহাড়িদের পালা দেশি মুরগি, বাঁশকোড়ল, ভাত, ভর্তা, ডিম/মাংস। এছাড়া অতিরিক্ত কিছু যদি তারা জোগাড় করতে পারেন তাহলে দিতে হয় বাড়তি চার্জ। খরচ ১০০-১৫০ টাকা। সকালের নাস্তার ক্ষেত্রেও একই হিসাব। তবে অধিকাংশ সময় তারা যেটা আয়োজন করেন সেটাই খেতে হয় পর্যটকদের। কারণ সবকিছু অনেক কষ্টে, খরচ বেশি করে আনতে হয় লেক পর্যন্ত।
বাঙালি খাবার আয়ত্ত করতেও দিদির সময় লেগেছে বেশ। কারণ তেল মসলার খাবারে পাহাড়ীরা অভ্যস্ত না। বাঙালিদের কাছ থেকেই শিখেছেন তিনি। যখন পর্যটক বেশি থাকে তখন পাড়ার যেকোনো ঘর থেকে দুজন নারীকে ১ সপ্তাহের জন্য কাজে নেওয়া হয়। সপ্তাহ পেরুলে আবার অন্য দুজন। এভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করছেন দিদি। বগালেকে এখন সিয়াম দিদি, লারাম, শিউলি বমসহ কয়েকজনের কটেজে ২শ' জনও থাকা সম্ভব।
এছাড়াও বান্দরবানে দেখার আরো অনেক কিছু রয়েছে। অর্থ এবং সময়ের কারণে সেগুলো দর্শনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম। তবে কখনো যদি সুযোগ হয় আবার ছুটে যাবো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রাজধানী বান্দরবানে। ২য় বার যাদের দারুণ সঙ্গ পেয়েছি তাদের মধ্যে রয়েছেন মহসনি খান, আলী আলম, খাইরুল আজিজ সাগর, আলী ভাইয়ের শালা ও মহসিন ভাইয়ের ছেলে। ফিরতি পথে আমরা পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এবং টিএসপি সার কারখানা পরিদর্শন করি। একই সাথে পাহাড় আর সমুদ্রের স্বাদ উপভোগ করলাম। টিএসপিতে গিয়ে সার উৎপাদনের অভিজ্ঞতা নিলাম।
লেখক পরিচিতি : লেখক ও সাংবাদিক, [email protected]
ফজর | ৪:৫৮ |
যোহর | ১১:৪৫ |
আসর | ৩:৩৬ |
মাগরিব | ৫:১৫ |
এশা | ৬:৩১ |
হেরার আলো
|
বাণী চিরন্তন
|
আল-হাদিস
|
৬৬-সূরা তাহ্রীম ১২ আয়াত, ২ রুকু, মাদানী পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
৬। হে মু'মিনগণ! তোমরা নিজদিগকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর অগি্ন হইতে, যাহার ইন্ধন হইবে মানুষ ও প্রস্তর, যাহাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয়, কঠোরস্বভাব ফিরিশতাগণ, যাহারা অমান্য করে না তাহা, যাহা আল্লাহ তাহাদিগকে আদেশ করেন। আর তাহারা যাহা করিতে আদিষ্ট হয় তাহাই করেন।
শুধুমাত্র অস্তিত্ব রক্ষার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। -শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বিদ্যালাভ করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য। |
করোনা পরিস্থিতি | ||
বাংলাদেশ | বিশ্ব | |
আক্রান্ত | ৭,৫১,৬৫৯ | ১৬,৮০,১৩,৪১৫ |
সুস্থ | ৭,৩২,৮১০ | ১৪,৯৩,৫৬,৭৪৮ |
মৃত্যু | ১২,৪৪১ | ৩৪,৮৮,২৩৭ |
দেশ | ২০০ ২১৩ | |
সূত্র: আইইডিসিআর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। |
হ্যাঁ | না | মতামত নেই |